ভাষা আন্দোলন রচনা ১৫+ পয়েন্ট | প্রবন্ধ রচনা

SHARE:

ভাষা আন্দোলন রচনা ১৫+ পয়েন্ট | প্রবন্ধ রচনা

 ভাষা আন্দোলন রচনা ১৫+ পয়েন্ট | প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা :

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা, যা বাঙালি জাতির পরিচয় ও স্বাধীনতা অর্জনের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, এই দিনটি বাঙালি জাতির জন্য এক অমর দিন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সেদিন যে তরুণেরা রক্ত ঝরিয়েছিল, তাদের সেই ত্যাগ ও সংগ্রামের ফলেই আজ আমরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করেছি। ভাষা আন্দোলন শুধু একটি ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই ছিল না, এটি ছিল বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রথম মুক্তির বার্তা।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি :

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয় । পাকিস্তান দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল—পূর্ব বাংলা (পরে পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুই অংশের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জীবনধারায় ছিল মৌলিক পার্থক্য। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয় যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বাংলাভাষী। এই প্রতিবাদের ধারায় গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিশ ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়, যা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়।

আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার :

ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে, যখন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্ত বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদের জন্ম দেয়। প্রথমে গঠিত হয় তমদ্দুন মজলিশ, পরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, যারা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগঠিত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সাধারণ জনগণ সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়, যাতে কয়েকজন শহীদ হন। এই ঘটনার মাধ্যমে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এবং ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

ভাষা আন্দোলনের প্রধান অধ্যায় শুরু হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আবারও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাঙালি ছাত্রসমাজের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাতে প্রস্তুত হতে থাকে।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ঢাকার রাজপথে নামেন হাজার হাজার ছাত্র। তাদের একমাত্র দাবি ছিল, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। সরকার এই বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু ছাত্ররা সরকারের এই আদেশ অমান্য করে রাস্তায় নেমে আসেন। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেক ছাত্র নিহত হন। এই রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়।


ভাষা আন্দোলনের ফলাফল

ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মধ্যে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের চেতনা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার আজ জাতীয় ঐক্য ও আত্মত্যাগের প্রতীক।

২১শে ফেব্রুয়ারি: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি

২১শে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি সারা বিশ্বের জন্য একটি গর্বের দিন। ১৯৯৯ সালে, ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।এভাবে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিশ্ব দরবারে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য :

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য বহুমুখী। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় কেবল যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়, বাঙালির জাতীয় চেতনাকেও ভাষা আন্দোলন ফটিক-স্বচ্ছতা দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের ওপর যে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন চালায় তার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনায় সংগঠিত হতে ভাষা আন্দোলন আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের সচেতন, সক্রিয় ও উদ্বুদ্ধ করেছে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে।

জাতীয়তাবাদের উন্মেষ :

ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল না, এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে যে চেতনার জন্ম হয়, তা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তোলে।এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বুঝতে পারে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়, সংস্কৃতি ও অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তা।

ভাষা আন্দোলনের চেতনায় স্বাধীনতার বীজমন্ত্র :

ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণ-আন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ঐ আন্দোলন। সেদিন বাঙালির আত্মসচেতনতার যে উদ্বোধন ঘটেছিল তাই নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে। ভাষা আন্দোলনের চেতনা পরিণতি লাভ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়।

ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও জাতিসত্তার স্বরূপ :

আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারেও ভাষা আন্দোলনের অবদান অসামান্য। আমরা জেনেছি আমরা বাঙালি। জেনেছি বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ আমাদের দেশ। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর ও একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ঠিকানা ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে লড়াই করেছি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা।

সাংস্কৃতিক বিকাশের চেতনা :

আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের এক বীণা। তাতে কত না সুর, কত না ঝংকার। ভাষা আন্দোলনের এই বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি। ভাষা আন্দোলনের ফসল আবদুল গাফফার চৌধুরীর অনন্য গান: 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?' — এ গান আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনী মন্ত্রের প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের চেতনার পথ ধরে আমরা অর্জন করেছি আরো কত দেশাত্মবোধক গান।

ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও সাহিত্য :

ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের সাহিত্য-অঙ্গনেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে, ফলিয়েছে অজস্র ফসল। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর 'কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।' এর পর অফুরান সৃষ্টিতে ভরে গেছে আমাদের সাহিত্যের ডালি। ভাষা আন্দোলনের আরেক অনবদ্য ফসল চিরভাস্বর হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত সংকলন 'একুশে ফেব্রুয়ারি'। তারপর প্রতিবছর ভাষা আন্দোলন উদ্যাপন উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে অজস্র সংকলন। এভাবে ভাষা আন্দোলন পরিণত হয়েছে আমাদের জাতীয় উৎসবে।

ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা

ভাষা আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে যে মাতৃভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি জাতির আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি। ভাষার অধিকার রক্ষায় আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত বাঙালি জাতি স্থাপন করেছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এই আন্দোলন আমাদের জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করেছে। এটি প্রমাণ করেছে যে সংগঠিত প্রতিবাদ ও ঐক্যবদ্ধ মনোভাব জাতিকে বড় অর্জনের পথে নিয়ে যেতে পারে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে—নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ও পরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে এবং অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হতে।

আমাদের করণীয় :

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের শুধু গর্বিতই করে না, বরং দায়িত্বশীলও করে তোলে। শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে আমাদের করণীয় রয়েছে বহু। বাংলা ভাষার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় শহীদ মিনার ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত স্থাপনাগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের চেতনা শুধু অতীত নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তাই আমাদের করণীয় হলো এই চেতনা ধারণ করে জাতির উন্নয়ন ও ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া।

উপসংহার :

ভাষা আন্দোলন শুধু একটি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনার, সাংস্কৃতিক বিকাশের এবং সাহিত্যিক উন্মেষের এক অনন্য ভিত্তি। এই আন্দোলনের চেতনা আমাদের আত্মপরিচয় নির্মাণে এবং স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ভাষা আন্দোলন আমাদের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়, যা আজও আমাদের পথ দেখায়, প্রেরণা জোগায় এবং জাতিসত্তার ভিত্তিকে দৃঢ় করে।

COMMENTS

Loaded All Posts Not found any posts Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content